বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয় কীভাবে সেটি জানার আগ্রহ আমাদের অনেকের। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির একটি চির প্রেরণা ও অবিস্মরণীয় দিন হলেও এটি এখন শুধু বাংলাদেশের নয় সারা বিশ্বেই পালন করা হয়।  এই দিনটি বাঙালি জাতির জীবনের শোকাবহ একটি দিন কারণ এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ও সফিউররা। একই সাথে এই দিনটি আমাদের গৌরব উজ্জ্বল ও অহংকারে মহিমান্বিত একটি দিন। এই দিনটির বিনিময়ে আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলার মান রাখতে পেরেছি। মাতৃভাষার জন্য নিজেদের বুকের তাজা রক্ত রাজপথে ঢেলে দেওয়ার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে এটিই প্রথম।

তাই চলুন আজকের sheba.xyz ব্লগের মাধ্যমে দেখি বিশ্বব্যাপী কীভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয় তা সম্পর্কে।

বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয় যেভাবে

মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের উদ্যেগটি সর্বপ্রথম বাঙালিরাই নেয়। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোতে একুশে ফেব্রুয়ারিকে  আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদন করা হলে ইউনেস্কো বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের স্বীকৃতি প্রদান করে। পরবর্তী বছর থেকে অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকে পুরো বিশ্ব জুড়ে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এরপর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেও ২০১০ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করার স্বীকৃতি প্রদান করে।

বাংলাদেশের মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন শুরু করে। এদিন তারা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে খালি পায়ে শহীদ মিনারে যায় ফুল দিতে। ১৯৫৩ সাল থেকে এই দিনটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই দিনটি শহীদ দিবস হিসেবেও বেশি পরিচিত।  এই দিনে সবার মুখে মুখে একটি গান থাকে আর তা হচ্ছে-

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।”

এছাড়াও বাংলা একাডেমি একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলার আয়োজন করে থাকে। ইউনেস্কো প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিপাদ্য ঘোষণা করেন একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে। ইউনেস্কো ছাড়াও বিশ্বের আরো অনেক দেশ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে থাকে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসটির ইতিহাস ও তাৎপর্য জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাছাড়া বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশী প্রবাসী এবং বাংলাদেশের দূতাবাস এর উদ্যোগে এই দিবসটি পালন করা হয়। এখন চলুন জেনে নেই কোন দেশ কীভাবে এ দেশটিকে পালন করে থাকে!

ভারত:

বাংলা ভাষা কে মাতৃভাষা স্বীকৃতির দাবিতে আসামের বরাক উপত্যকার ১০ জনেরও বেশি মানুষ শহীদ হন। ভারতের পশ্চিম আসাম ও ত্রিপুরায় বাংলা ভাষাভাষী অনেক মানুষের বসবাস রয়েছে। ওই আন্দোলনের পর আসামেও বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এছাড়াও সেইসব শহীদদের স্মরণে আসামের শিলচরের গান্ধীবাদে একটি মিনার ও স্থাপিত হয়। বর্তমানে উনিশে মে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আসামের বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ এখানে পুস্ত স্তবক অর্পণ করে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশের সাথে মিল রেখে অনেকে একুশে ফেব্রুয়ারিতেও ফুল দিতে আসেন এখানে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া ও চন্দননগরেও রয়েছে দুটি শহীদ মিনার যেখানে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় ফুল দেয়ার মাধ্যমে।

পাকিস্তান:

যদিও পাকিস্তানে সরকারি উদ্যোগে এখনো জোড়ালোভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয় না তবে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে মর্যাদার সাথে এই দিবস নিয়ে বিভিন্ন আয়োজন করা হয়ে থাকে। পাকিস্তান ন্যাশনাল কাউন্সিল অব দ্য আর্টস এর পক্ষ থেকে গত বছর ইন্দুস কালচারাল ফোরামের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ৬ষ্ঠ পাকিস্তান মাতৃভাষা সাহিত্য মেলা আয়োজন করে। এতে অংশগ্রহণ করে দেশটির কমপক্ষে ২০ টি ভাষার লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও অ্যাক্টিভিস্টরা। সেই মেলায় কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানানো হয় পাকিস্তানের ৭০ টিরও বেশি ভাষা রক্ষার জন্য। এছাড়াও পাকিস্তানের ইকো সায়েন্স ফাউন্ডেশন, দ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ফোক অ্যান্ড ট্র্যাডিশনাল হেরিটেজও দিবসটি পালন করে।

কানাডা:

কানাডার পার্লামেন্ট আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য  ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সেই বছরই একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালনের ঘোষণা দেয় ব্রিটিশ কলম্বিয়া ও মানিটোবাতে। ২০১৭ সালে এডমন্টন প্রথমবার এ দিবসটি পালন করে।

যুক্তরাজ্য:

লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেলে আলতাব আলি পার্কে স্থাপন করা হয় ঢাকার শহীদ মিনারের একটি প্রতিরূপ যাতে কিনা প্রতিবছর এই দিবসটিতে সেখানকার স্থানীয়রা পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং সংগীত পরিবেশন করে থাকে। এছাড়াও বৃহত্তর ম্যানচেস্টারের ওয়েস্টউডে শহীদ মিনারের আরেকটি প্রতিরূপ স্থাপন করা হয়। এখানে এই একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করে থাকে উত্তর ইংল্যান্ডের মানুষেরা। এছাড়া বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক আয়োজনও দেখা যায় পূর্ব লন্ডনের কবি নজরুল সেন্টারে।

যুক্তরাষ্ট্র:

যুক্তরাষ্ট্রের ডাক বিভাগ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ২০১৬ সালে প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশ করে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ কার্যালয়ের সামনে অস্থায়ী শহীদ মিনার বানানো হয় যা মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ও বাঙালির চেতনা মঞ্চের উদ্যোগে আয়োজন করা হয়। ১৯৯২ সাল থেকে প্রবাসীদের নিয়ে মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন করে আসছে।

এছাড়া বাংলাদেশ দূতাবাস ও প্রবাসী বাংলাদেশের উদ্যোগে সুইডেন, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব, জর্ডানসহ বিভিন্ন দেশে এই দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। 

একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে বাংলাদেশের পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং পুষ্প স্থাপক করার মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হয় বিশ্বব্যাপী।

Leave a comment