১৯৫২ সাল। ২১শে ফেব্রুয়ারি। সালাম, জব্বার, রফিক -এর লাশ। ১৪৪ ধারা! ভাষা আন্দোলন এবং সবশেষে ভাষার স্বীকৃতি।

বাংলাভাষা নিয়ে এই গল্পটি জানে না এমন কেউ নেই! কিন্তু এখানেই গল্পের শুরু বা শেষ নয়।

ভাষা নিয়ে দৃঢ়ভাষা ব্যবহার করে অনেক আগে থেকেই আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটে। শুরু হয় ভাষার জন্য ভালোবাসার গোড়াপত্তন।

বৃটিশ সরকার উপমহাদেশ ছাড়ার পরপরই ভাষা নিয়ে অসন্তোষ শুরু হয় তৎকালীণ পাকিস্তানে। কৃষ্টি- সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন এই দুটি ভূখণ্ডকে জোড়া লাগিয়ে যে দেশের ঘোষনা দেয় বৃটিশ সরকার- সেই দেশে ভাষা নিয়ে গোলযোগ হবে এটাই স্বাভাবিক!

তাই ১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্তির পর থেকেই শুরু হয়ে যায় ভাষা নিয়ে তোলপাড়। বাংলার উপর উর্দুর চেপে আসা রোধে জেগে উঠে বাঙালি জাতি।

21st February, Mother Language Day, International Mother Language Day, Shahid Minar
শহীদ মিনার

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে তাদের অনুমোদিত বিষয়তালিকা থেকে বাদ দেয় ও সাথে সাথে মুদ্রা এবং ডাকটিকেট থেকেও বাংলা অক্ষর বিলুপ্ত করে।

কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান মালিক উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

একই সময়ে একটি শিক্ষা সমাবেশে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথে তোপের মুখেও তৎকালীণ শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় সমাবেশ,মিছিল! শুধু বাংলাকে আপন করার জন্য!

৮ ডিসেম্বর ১৯৪৭, আন্দোলন চলছে নিজের গতিতে। হচ্ছে মিছিল সমাবেশ। সেসময়েই একটি সমাবেশে গর্জে উঠে বাংলার হুঙ্কার- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই । জন্ম নেই এই যুগান্তকারী শ্লোগান।

২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮, কুমিল্লার নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিল আনেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার সম্মান জানাতে। এই প্রস্তাব ধোপে ঠেকেনি!

১১ মার্চ, ১৯৪৮, বাংলার জন্য হয় বাংলার বুকে ডাকা হয় ধর্মঘট।

২১ মার্চ ১৯৪৮, বাঙালিদের চাওয়া পাওয়া তুচ্ছ করে রেসকোর্স ময়দানের মোহম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষনা দেয়- উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা

২৪ মার্চ, ১৯৪৮, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে একই ঘোষনা দেয় জিন্নাহ। সেসময় উপস্থিত ছাত্র – শিক্ষক একই সাথে অসোন্তষ এবং “না” বলে প্রস্তাব মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান।

৯ মার্চ, ১৯৪৯, বাংলাকে নিয়ে টানা হেচড়ার সময় একটি অদ্ভুদ প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। বাংলা শব্দকে আরবী হরফে লেখার লেখার প্রস্তাব দেন খাজা নাজিমুদ্দীন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এই প্রস্তাবকে অবান্তর ও হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেন এবং অনড় থাকেন..দানা বাধতে থাকে বাংলার অভ্যত্থান!

২৭ জানুয়ারি. ১৯৫২, ফুসলে উঠে জনতা, মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে সেই কালজয়ী শ্লোগান- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

৩১ জানুয়ারি, ১৯৫২, পূর্বপাকিস্তানের বুকে জন্ম নেয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ- ২১ ফেব্রুয়ারিতে আহবান করা হয় ধর্মঘটের। এই দলের সদস্য ছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবি জনতা, শিক্ষক, ছাত্র এমনকী পাশের বাড়ির মুখচোড়া মেয়েটির মত নিতান্তই সাধারণ মানুষও।

১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। ২১ ফেব্রুয়ারি আসার আগেই যে উত্তাপ ছড়াতে থাকে সাধারণ জনতার অসেন্তাষ, সেই উত্তাপে শঙ্কিত হয়ে উত্তাল জনতাকে থামাতে জারি হয় ১৪৪ ধারা

এতে কোনও লাভ তো হয়নি। বরং ১৪৪ ধারাকে সামনে রেখে কি করে রাজপথে নিজের দাবী নিয়ে নামা যায় সেই পরকিল্পনা করতে থাকেন সবাই মিলে।

আরো পড়ুনঃ বসন্ত এসে গেছে!

ফের আসে সেই দিন।

একুশে ফেব্রুয়ারি, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ভাষার জন্য শহীদ হন সালাম, রফিক , জব্বার সহ নয় বছরের শিশুও। গুলি ছুড়লেও সেদিন বাংলার বুলি থামাতে পারেনি শোষকগোষ্ঠী।

২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। তাৎক্ষণিক সীদ্ধান্তে শহীদদের সম্মাননা জানাতে মেডিকেল কলেজের সামনে তৈরি করা হয় শহীদ মিনার। যে শহীদ মিনারটি বানানো হয় সেটি ছিল ১০ ফুট উচু আর ৬ ফুট চওড়া।

মিনার তৈরির তদারকিতে ছিলেন জিএস শরফুদ্দিন (ইঞ্জিনিয়ার শরফুদ্দিন নামে পরিচিত), নকশা অঙ্কন করেছিলেন বদরুল আলম। তাঁদের সাথে ছিলেন সাঈদ হায়দার। তাদের সহযোগিতা করেন দুইজন রাজমিস্ত্রী।

মেডিকেল কলেজের সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ইট, বালি এবং পুরান ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে সিমেন্ট আনা হয়।

২৬ ফ্রেব্রুয়ারি ১৯৫২, জাগরণে ভীত পাক সরকার সেই মিনার গুড়িয়ে দেয়- তবুও কী থামাতে পেরেছিল ভাষার জন্য ভালোবাসার স্রোত? সেই স্রোত তখন রাজপথ থেকে ছড়িয়ে গেছে বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে।

ফলাফল?

২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৬ সাল, বাংলার মানুষের প্রতিবাদের মুখে বাংলাকে দেওয়া হয় তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার সম্মান!

১৯৫৭ সাল। ভাষ্কর হামিদুজ্জামানের নকশায় আবারো শহীদ মিনারের নির্মান শুরু হয়। যা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে মূল নকলা থেকে কিছুটা পরিবর্তন সাপেক্ষে অনেক দিন ধরে চলমান প্রকৃয়াতে থাকে।

২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৩। অবশেষ শহীদ মিনার ভাষা আন্দোলনের স্মারক হয়ে মাথা জাগিয়ে তোলে। যা্র উদ্বোধনর করেন ভাষা শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম।

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার সম্মান পায় এই বাংলা। শুধু তাই নয়।

ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য ছাড়ায় বাংলাদেশীদের প্রতি সম্মান জানাতে সিয়েরা লিওনেও দ্বিতীয় দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলা ভাষা।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে দুটি সিনেমা তৈরি হয়েছে এখন পর্যন্ত। একটি জহির রায়হান-এর কালজয়ী সিনেমা “জীবন থেকে নেয়া” এবং আরেকটি শহীদুল ইসলাম খোকনের “বাঙলা”।

সিনেমায়, গানে কবিতায় মুখের ভাষায়- কোথায় নেই বাংলার প্রতি ভালোবাসা আর টান! দিনের পর দিন যারা দেশের বাইরে থাকেন – তারাও বাংলাদেশি দেখলে ছুটে আসেন – শুধু মাত্র নিজের ভাষায় কথা বলতে পারার জন্য।

“আমার সোনার বাংলা” “আমি বাংলায় গান গাই” গানগুলো শুনলে শিহরিত হয়ে চোখ ভিজে উঠে।

এ যদি ভাষার জন্য প্রেম না হয় – তাহলে প্রেমের সংজ্ঞা কী! আমরা সেই জাতি যারা ভাষার জন্য লড়েছি। পৃথিবীতে এমন ঘটনা বিরল! এজন্য বাংলায় এমন একটি শব্দ আছে যেটাকে অন্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। তা হলো “অভিমান”।

আমরা আমাদের আবেদ জন্ম নেয় অভিমানে- জয় পায় আন্দোলনে। এই তো বাংলার সৌন্দর্য।

প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী” গেয়ে ফুল নিয়ে জড় হয় শত শত মানুষ সে সকল ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান জানাতে যাদের বদৌলতে আমরা পেয়েছি অমর একুশে

১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।

এটি শুধু একটি গল্প নয়। এটি আমাদের গর্ব। আজন্ম। আমরণ।

 

Leave a comment